৫.
পাহাড় পিছিয়ে যেতে লাগল। কে কইসে পাহাড় পিছিয়ে গেছে ? কংস নদীর ওপারে যাও, একটু বাদে আর পাহাড় দেখা যাবে না। আগে দেখা যেত। মৈমনসিং নগর থেকেও দেখা যেত। এখন নেত্রকোনা থেকে দেখা যায় না। কিন্তু পাহাড় তো নিশ্চল। সে কী করে পিছিয়ে যায় ? তা কখনো হয়। এই যে তোমার ক্ষেত-জমি, তা তো তার জায়গাতেই থাকে। এই যে তোমার ভিটে-বাড়ি, তা কি মাইল মাইল দূরে চলে যায়। রাজার বাড়ি, রাজার বাড়ি তো রাজার বাড়িতেই থাকে। সেই যে কমলা সায়র, সে কি তার নিজের জায়গায় নেই? কংস নদী পার হয়ে বিরিসিরির দিকে আরো উত্তরে যাও, পথের প্রায় ধারে রানি কমলার দিঘি পড়ে আছে। দিঘি বলে চিনতে পারবে না, শুধু পাড় দেখে বুঝা যায়, কী ছিল আর কী হয়েছে। কিন্তু দিঘি তার জায়গাতেই আছে। শুধু সোমেশ্বরী নদী সরে গেছে কিংবা কাছে এসে গেছে। কী হয়েছে নদীর তা বলা যাবে না, কেন না নদী হয় চঞ্চলমতি, আর পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী হয় ক্ষিপ্রগতি সম্পন্না। কখনোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। আর একটা কথা, রানি কমলার সময়ের কেউ তো আর নেই যে বলবে সোমেশ্বরী নদী, আমাদের সিমসাং নদী কোন জায়গা দিয়ে বয়ে যেত, কোন জায়গা দিয়ে বয়ে যেত না। মানুষ থাকেনা, বাকি সব থেকে যায়। সাক্ষী মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, ফলে নদী পাহাড়, বন, ক্ষেত-খামার পাহাড়কে দেখে মনে হয় নিশ্চল । তার নড়ন নেই, চড়ন নেই। সচল পাহাড় হলো হস্তি। সচল পাহাড় ধরে ধরে হাজংরা রাজার আদেশ পালন করে, তা দেখে গারো পাহাড়ের চোখে পানি এল। গারো পাহাড় আসলে এক বুড়ো হাতি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চল হয়েছে। হাজংরা যে হাতি খেদিয়ে দুর্গের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়, তা তো গারো পাহাড়ের বনের প্রাণী। হাতি ধরে হাতির পায়ে শিকল পরালে পাহাড়ের কষ্ট হয়। গারো পাহাড়ের চোখের পানি থেকেই তো সিমসাং নদীর জন্ম। যদিবা বলে, গারো পাহাড়ের রমফা নদী, বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া ঝর্নার যত জল সব মিলিয়েই সিমসাং নদী, সোমেশ্বরীর জন্ম। কিন্তু কে না জানে রমফা নদী, বিঞ্চুরীচড়া আর বাঙাছড়া ঝর্না তো গারো পাহাড়েরই চোখে জল। সিমসাং নদীর নাম রাজা সোমেশ্বরের নামেই হয়ে যায় সোমেশ্বরী। মুদের নদী তাহাদের হই গেল এই রকমে। কিন্তু মুরা তারে সিমসাং কহি পুনরায়। পাহাড় নদী ঝর্না সব মুদের, পাহাড়িয়া গারো আর হাজংদিগের। তা রাজা নিয়ে নিল। সেই দুঃখে একবার সিমসাং নদী দিয়ে গারো পাহাড়ের চোখের জল নেমে এসে বানা লাগিয়ে দেয়। সেই এক রোদনেই গারো পাহাড়ের চোখের জল শুকালো। নদী শুকালো শুখার দিন আর যায়ই না। বানার পানি চলে গেলে, সিমসাং নদী শুকিয়ে যেতে লাগল, আর গাঙে পানি না থাকলে চাষবাস তো শেষ হয়ে যায়। হাজংরা বলল, আর হাতি ধরে দেবে না। তারা হাতি ধরত আর রাজা হাতি বিক্রি করত, ভেট পাঠাত মুর্শিদাবাদ, আগ্রা, দিল্লি। আবার বেচা কেনাও হতো অনেক। মুঘল সম্রাটের কাছেও হাতি বেচে তংকা আসত রাজার ঘরে। কিন্তু হাতি ধরতে গিয়ে হাজংদের পেটে ভাত আসে না। চাষের সময় নাই।
পেটে ভাত আসে না , এ কথা কেন ? চাষের সময় ? সে সময় কি হাতি ধরা বাদ দিয়ে আসবে ? চাষবাসের সঙ্গে দুর্গাপুরের হাজংদের সম্পর্ক কী ? তাদের নিষ্কর জমি দেওয়া হয়েছিল হাতি ধরার জন্য। তাদের কাজ হাতি ধরা। বনের হাতিকে খেদিয়ে দুর্গের ভিতর ঢুকিয়ে কুনকি হাতি পোষ মানিয়ে শিকলে বাঁধা। আগে হাতি ধরা পরে চাষ। গারো পাহাড়ের চোখে জল বললে হবে ? জমি দেওয়া হয়েছে, চষে পেটের ভাত তুলবে বিনিময়ে হাতি চাই। রাজার কাজ হাতি বেচা, প্রজা হাজঙের কাজ হাতি ধরা।
কিন্তু পেটে যদি ভাত না আসে হাতি ধরবে কেমন করে ?
তা বললে হবে, সব বাহানা। নিষ্কর জমি কি এমনি দেওয়া ? না, কিন্তু তাদের তো জমি ছিল, গাঁও ছিল গারো পাহাড়ের ঢালে। তাদের ডেকে এনেছিল সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজা। এসে পেটের ভাত গেল।
শুনুন তার নাম ছিল, মনা সর্দার। বীর হাজং। তখন সিমসাং নদী শুখা হয়ে যাচ্ছে। অথচ তার ছিল কত জল। কত ঢেউ। মনা সর্দারের ছিল খুব রোষ। মনা সর্দার আবার ছিল রাজার মাহুত, হাতি তার বাধ্য খুব, হাতি পোষ মানে তার হাতে। দুহাতের পাতা মুখের কাছে এনে এমন বিচিত্র আওয়াজ তোলে যে হাতি বনের ভিতর থেকে সাড়া দেয়। রাজার হাতিশালা থেকে সাড়া দেয়। সেই মনা সর্দার কী বলল, সন্ধেয় তার ভিটের উঠনে বসে,
বাপে বাইছে হাল, মা কাটিছে অরণ্যত জং
তেতিয়ার পরাই উৎপত্তি হ’ল হাজং।
কিন্তু আমরা আর চাষ কাজ করি কই? দুর্গাপুরের রাজা আমাদের নামিয়ে আনল গারো পাহাড় থেকে, গারো গিলা আমলা নাম থুছে আজং। আজং থেকে হাজং। গারোরা আ-হা বলে মাটিকে, আর জং হলো মাটির প্রাণী, পোকা। মনা সর্দার বলে, শুনো ভাই, আমাদের জন্ম হলো মাটি থেকে, আমরা চাষবাস করি বাঁচি, হাতি খেদার কাম আর করব না।
রাজা কইসে হাতি খেদাৎ, হাতি খেদাইয়া হাওরের ভিতর ফেলে হাতি ধরা, আমলা গারো পাহাড়ের থেকে নামসি হাতি ধরা কাম করার কারণে, হাতি না ধরি যদি রাজা অখুশি হবেন। বলল রাবন হাজং।
মনা সর্দার বলে, হাতি খেদার কাম করতে গিয়া জমি পড়ে থাকে, চাষবাস বন্ধ, ফসল যদিবা হয়, খেতে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়, অপর লোকে কাটি নেয়, ইকামে টঙ্কা নাই, আমলা ই কাম করব না।
সন্ধ্যা তারাটি শুনল আকাশের দূর পশ্চিমে ভেসে। ঐদিকে কত পাহাড়। আসাম পাহাড়ের শেষ নাই। সেই পাহাড়ের নিচে জমির পর জমি। কত ফসল উঠত। পাবনী পূজা হতো। পাবনী দেবতা হলো মদন ঠাকুর। বৈশাখে বাস্তু পূজার সময় পাবনীর পূজা, আমলা সব ভুলি গিইসি…।
সকলের মনে পড়ল, গেল বৈশাখে তাদের গ্রাম দেবতা, বইসি পূজা নম নম করে হয়েছিল। মৈমনসিঙের সেরেস্তাদার দুইটা হস্তি কিনতে চায়। হাতি খেদাইয়া আনো গারো পাহাড় থেকে…।
ভুঁইয়া সেরেস্তাদার দুইটা হস্তি চায়
কে দিবে হস্তি, হায়।
রাজা হাতি এখন চায়,
খেতির কামে কাজ নায় ।
মনা সর্দার বলল, খেতি করবা না হাতি ধরবা ?
সকলে চুপ। মনের কথা মুখে বলতে ভয় হয়। বাতাসে কথা ভাসিয়ে নিয়ে যায় রাজার বাড়িতে। কোনো কথাই চাপা থাকে না, তাই সকলে চুপ। অথচ বুক ফাটে বলতে, হাতি ধরা করব না, রাজার আদেশ মানব না, হাজং জাতি ক্ষেতি-কাম করে, তাই করবে।
অথচ এও সত্য যে রাজার আদেশ না মানলে রাজা সিপাই পাঠাবে। রাজার সিপাইয়ের পর মৈমনসিঙের সেরেস্তাদার তসিলদার হুজুর। সিপাই পাঠাবে। এমন কি হয় না? মৈমনসিং থেকে সেরেস্তাদার কিংবা তসিলদার হুজুর ঘোড়ায় চেপে আসে, হানা দেবে বস্তিতে বস্তিতে। তখন ?
মনা সর্দার বলল, সব্বোজনে মিলি দাবী তুলো, ক্ষেতি করব, হস্তি খেদাইব না।
তখন অথৈচন্দ্র নামের এক হাজং যুবক বলল, সকলে মিলা রাজার কাছে যাই, আর বলি আমলা ক্ষেতি করব, হস্তি খেদাইব না।
কেউই তার কথায় সাড়া দিল না। কিন্তু অন্ধকারে মনে মনে সবাই বলতে লাগল, হস্তি খেদাইব না। হাতি খেদানো মহা পাপ। কেন পাপ ? হাতি খেদাইলে গারো পাহাড়ের বুকে ব্যথা লাগে। হাতি তো গারোপাহাড়ের গা থেকে জন্মায়। বনের প্রাণী।
মনা সর্দার বলল, না যাবা তো ভুখে মরো।
হুঁ, ভুখ হবে ক্ষেতি না করলে। কে যেন বিড়বিড় করল।
মনা সর্দার বলল, হাতি খেদাইতে আমলা কি জন্ম নিসি ?
না। কে একজন বলে, হাজং মানে মাটির পুকা, মাটির মাকড়, ফসল ফলাইতে মুদের জন্ম।
মনা সর্দার বলে, তবে কেনে সে হাতি খেদায়, হাতি খেদা বন্ধ করো।
অন্ধকারে কে একজন বলে, বন্ধ করো।
জোরে বলো, এমন করে বলা করতে হবে যেন রাজার কানে যায়।
সকলে চুপ করে থাকে। বৈশাখ গেছে সবে। মেঘ আসছে যাচ্ছে। বর্ষা আসবে আসবে করছে। এসে গেলেই নামতে হবে লাঙল নিয়ে। এই সময়ই রাজার পেয়াদা এসে খবর দিয়েছে হাতি ধরে দিতে হবে। দুইটা হাতি চায় মৈমনসিঙের সেরেস্তাদার, তসিলদার আর একটা চায় রাজা। না ধরে দিলে রাজার গোঁসা হবে, সেরেস্তাদারের গোঁসা হবে, গোঁসা হবে তসিলদারের। খাজনা নিয়ে জুলুম হবে। মুর্শিদাবাদ থেকে দিল্লি পর্যন্ত খবর চলে যাবে। তখন কী জানি কী হবে ? মনা সর্দার বলল, রাজার কাছৎ যাওয়া লাগবে, আর্জি দিয়া লাগবে।
রাজা ! তার কাছে কে যাবে ? রাজার বাড়ি এই দুরগাপুরেই বটে, কিন্তু মনে হয় কতদূর! রাজার বাড়িতে ঢুকতে দেবে কেন ? রাজার সঙ্গে দেখা হবেই বা কেন ? তারা হাজং। তারা মাটির পোকা। তাদের কাজ হাতি খেদায় ফেলা। রাজাকে তারা দ্যাখেনি। রাজার পাইক-বরকন্দাজ এসে লাঠি ঘুরিয়ে, চোঙা ফুঁকে খবর দিয়ে যায় কী করতে হবে। কথাটা সবাই ভাবল। বিড়বিড় করল। রাজার কাছে তাদের কথা নিয়ে যাবে কে ? আর নিয়ে গেলে তার সঙ্গে রাজার দেখা হবে কেন ? পাইক-বরকন্দাজকে বলে আসতে হবে। তার উপরে মন্ত্রী, সান্ত্রী, সেনাপতি কাউকে বলা যাবে না। দেখাই হবে না। কে যাবে ? কার সেই সাহস আছে এই কথা বলার ? মনা সর্দার বলল, সকলৎ গিয়া বলা করৎ হবে।
সকলে গিয়ে! সকলে গিয়ে কি বলা হয় ? তাহলে কার কথা শুনবে কে ? মনা সর্দার বলে, সকলৎ রাজার বাড়ির সমুখে গিয়ে আওয়াজ তুলে বলা করতে হবে হাতি ধরা হবে না।
হ্যাঁ, হাতি ধরা হবে না। পরপর কদিন সন্ধে বেলায় কথা হতে লাগল। এই কথা নিয়ে জোয়ান অথৈচন্দ্র লীলাবতীর কাছে গেল। বনের ভিতরে দাঁড়িয়ে কোকিল ডেকে লীলাবতীকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এল অথৈচন্দ্র অনেক রকম ডাক জানে। কোকিল, ঘুঘু, কুবো, রাজহংস, ব্যাঘ্র, হস্তি, শৃগাল…। লীলাবতী শুনল হাতি না ধরার পণের কথা। লীলাবতীর গ্রাম চম্পানগর। কংস নদীর ধার। লীলাবতীর এখন বসন্তদিন। সমস্ত শরীরে সাড়া জেগেছে। সে যেন প্রস্ফুটিত বনের ফুল। মুখখানিতে বাবার ছায়া। গায়ের মাখন বর্ণ মায়ের কাছে পাওয়া। পীন পয়োধরা, চকিত চঞ্চলা কন্যার অঙ্গে অঙ্গে ফুলের বাস বুঝি। তেমনি পেয়েছে অথৈচন্দ্র। সে বিরিসিরি, দুর্গাপুর থেকে দশ মাইল ছুটতে ছুটতে আসে কংস নদীর ধারে জারুল বনের ধারে। লীলা আসবে সেখানে। কথা হবে। লীলাকে সব বলা হবে। না বললে সে কাজে মনই পাবে না। রাজার বাড়ির রথ যাত্রার মেলায় আর বছরে সে লীলাবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, ভালোবেসেছিল। তখন লীলাবতী ছিল কিশোরী। এখন যুবতী। যৌবন এসেছে অথৈচন্দ্রের হাত ধরতে। অথৈচন্দ্রের চুম্বনে। দংশনে। লীলাবতীর বাবা ব্রাহ্মণ। পতিত। পতিত কেন না তার মা গারো পাহাড়ের। লীলাবতীর বাবা পাহাড়ে গিয়েছিল কাঠ আনতে। ঐ কাঠের বিনিময়ে রাজার খাজনা মিটাতে হবে।কাঠ চিরে রাজার প্রমোদ-ঘর হবে। কী কাঠ, সেগুন, মেহগনি, শাল। পরপর কদিন ধরেই আনছিল। সে বড় ভালো দিন ছিল। বসন্ত কাল। বনের গাছ নিষ্পত্র হয়েছিল সমস্ত শীতকাল ধরে। বসন্ত এসেছিল দশদিক জানান দিয়ে। ফুল ফুটেছিল বনের হেথাহোথা। পথের ধারে। দূরে কাছে। ভ্রমর ভ্রমরা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছিল। গারো মেয়ের মুখোমুখি হয় পাহাড় থেকে মস্ত এক কাঠের গুড়ি হাজং এক জোয়ানের পিঠে দিয়ে নেমে আসার পথে। লীলাবতীর বাবা শীতলচন্দ্র কদিন ধরেই কাঠ নিয়ে পাহাড় থেকে নামছিল। তখন রোদ হয়েছে খুব। তাপ হয়েছে খুব। গারো পাহাড়ের কন্যা ফুলমণি তার শক্তিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে এগিয়েছিল। এইটুকু জানে লীলাবতী। মা তাকে এইটুকু শুনিয়েছে। বাকিটা কী বোঝেনি লীলাবতী। প্রথম দেখায় পাহাড়িয়া মেয়েকে পাহাড় থেকে নামিয়ে এনেছিল শীতলচন্দ্র। এ নিয়ে গোলমাল কম হয়নি। কিন্তু বিবাহ করেছিল তারা রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে মালা বদল করে। রাত্রিবাস করেছিল একত্রে। আর কী করার থাকে। চাষার পুত বিয়া করে ফেলেছে, সুতরাং মেনে নাও।
লীলাবতীর হাত ধরে আছে অথৈচন্দ্র। লীলাবতী জিজ্ঞেস করল, হাতিধরা না কর তো ভালো।
অথৈচন্দ্র বলে, রাজার আদেশ মানব না ?
না মানবে না। লীলাবতী খুব সাহসী, লীলাবতী বলল, বনের হাতি বনে রহুক, বনের পাখি বনে রহুক, উয়াদের ধরা ঠিক না, পাপ হয়।
রাজার বাড়ি তাহ্লে যাব ?
যাবা। বলল লীলাবতী, গিয়া বলবা হাতি ধরা বন্ধ।
তাই করব, লীলা যা বলে তাই করব।
বিয়া করবা কবে ?
রাজার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি, বিয়ার পর ঘরে নি যা্ব। বলল অথৈচন্দ্র।
সত্যি ? লীলাবতীর মুখে হাসি ধরে না আর।
সত্যি।
চুমা দিয়ে বল সত্যি। আহ্লাদে অথৈচন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে লীলাবতী। গলা বেড় দেয়। চুমা দিয়ে যাও।
চুমা দিল অথৈ। অথৈ তার নাম। নির্জন বনের ভিতর সে অথৈ চুমা দিল। ঠোঁঠে, চোখে, গালে। বুক থেকে আঁচল সরিয়ে মধু ভান্ডের মতো দুই স্তনে। তা পরিপূর্ণ হয়েছে ঘটের মতো। সুগোল, সুপুষ্ট। স্তনাগ্র ঘিরে আছে রক্তাভ বলয়। সেখানে চুমা দিল অথৈ। লীলাবতী, আমি রাজার বাড়ি থেকে এসে তোরে বিয়া করে নিয়া যাব।
লীলাবতী তার বুকে মুখ ঘষতে থাকে। সে কংস নদীর কূলের মেয়ে। তার মা গারো পাহাড়ের মেয়ে। মা বাবার দেখা হলো চৈত্র পূর্ণিমায়। কাম দেবের পুজা ছিল সেদিন হাজং পল্লীতে। সেদিনের ন’মাসের মাসে তার জন্ম। লীলাবতীর হাত মুঠিতে ধরেছে অথৈ যৌবন। কোমলে কঠোরে উদ্দীপ্ত যৌবন ফুঁসছে। লীলাবতী তা ছাড়ছে না। মুঠিতে ধরে কাঁপছে। পুরুষ ! অথৈ বলল, মরে যাই লীলা, মরে যাই।
আমিও মরে যাই অথৈ, মরে যাই।
মরে যাই অথৈ, অথৈ গাঙের ঢেউ।
সিমসাং কংস নদী, নিবেনি আর কেউ।
অথৈ গো। বলতে বলতে লীলাবতী তার গায়ে নিজেকে ছেড়ে দিল অবশ হয়ে। সেদিন আর রক্ষে হলো না কারো। এক পন্ডিত মানুষ পুঁথিপত্র হাতে পার হচ্ছিল বনপথ। দেখল যুবতীর অঙ্গে বস্ত্র নেই। জোয়ানের দেহ দুলছে। বনের ভিতরে ঝড় উঠেছে। গাছ-গাছালি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সর্বনাশ হতে আর দেরি নেই। সে হেঁকে উঠল, এই তোরা কেডা রে কেডা ?
৬.
বামুন-পন্ডিতের নাম ত্রিলোচন ? জিজ্ঞেস করেছে বিপুল।
হুঁ। অবাক হয়ে তাকালেন অতীন সরকার, আমারে কহিসিল চন্দ্রকুমার।
বিপুল তাকায় চন্দ্রকুমারের দিকে। চন্দ্রকুমার বলল, আমি শুনিসিলাম, তবে খবরের সোর্স বলা যায় না, মু বাণেশ্বর খবরিয়ার বংশধর, খবরটাই শুধু বলি।
বাইরে আলো ফুটছে। পাখিরা জেগে উঠছে একের পর এক। বিপুল কল্পনা করতে চায় সিমসাং-সোমেশ্বরী আর গারো পাহাড়, আর কংস নদী। দশ মাইল ছুটে সে যায় কংস নদীর ধারে, দশ মাইল ছুটে সে ফেরে গারো পাহাড়ের কোলে হাজং বসতিতে। তখন মনা সর্দার সেই কথাই বলছে, যদি হাজংরা বাঁচতে চায় তো হাতি খেদা না করুক। অথৈ পরিপূর্ণ হতে হতে হয়নি আজ। বুড়ো বামুন নারী পুরুষের মিলনের গন্ধ পেয়েছিল হয়তো বনপথে। দশ মাইল ছুটতে ছুটতে তার মনে ভাসছিল যুবতীর অপরূপ দেহ সৌষ্ঠব। তার যে দেশ, তার যে গ্রাম, তার যে পাহাড়, নদী সবের ছায়া তার ভিতরে। লীলাবতীর কোমল হাত মুঠিতে ধরেছিল তাকে। তার সর্বস্ব কিছুকে। আহা সেই ছোঁয়াতেই ভরে গেছে সব। এখনো কাঁপুনি থামেনি। থামবে না যত দিন সে লীলাবতীকে নিয়ে ঘর না বাঁধবে। মনা সর্দার বলছে, কী করবা কহি দাও।
সকলে চুপ। অথৈচন্দ্র সবে পৌঁছে প্রাণ ভরে পানি খায় ঘটি ঘটি। তারপর গর্জন করে ওঠে, হাতি খেদা বন্ধ হোক।
না বলে তার উপায় নেই। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কংস নদীর তীরের মেয়ে। লীলাবতী তার সঙ্গে ভেসে এসেছে তার সুগন্ধ নিয়ে। লীলাবতীই তাকে উসকেছে, কহ। কহি দাও।
সুতরাং অথৈ বলে দেয়। আরে আরে কে বলে, না বাপ মরা ছেলে অথৈচন্দ্র ? হাজংরা কি জানে সর্ষের ভিতরে ভূত থাকে ? হাজংরা কি জানে লৌহবাসরে ছিদ্র থাকে ? মা মনসার মঙ্গল কাহিনি কি পড়েনি তারা ? মনা সর্দার এতদিনে ফল পায়। সে দুর্দম পুরুষ। সে বুঝল একজন হাঁ করলে, আস্তে আস্তে ভয় ভাঙবে এক একজনের। ভয় সকলের ভাঙবে। অথৈ কি জানে তার বাপ মরেছিল হাতি খেদাতে গিয়ে হাতির পায়ের নিচে পড়ে। না জানে না। তার মা জানে, কিন্তু বলেনি। কেন বলেনি, না বললে তার জোয়ান ছেলের ভিতরে ভয় ঢুকে যাবে। জোয়ান ছেলের ভিতরে হাতি না ধরার মন হবে। হাতি তো ধরতে হবেই। সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজা হাতি খেদাতেই হাজং জাতিকে পাহাড় থেকে নামিয়ে এনেছিল।
সুসঙ্গ কেন ? সুসঙ্গ রাজার দেওয়া বিশেষণ। সব রাজা-রাজড়ার সঙ্গ হলো সুসঙ্গ। বলতে থাকে চন্দ্রকুমার। ৬৮৬ বঙ্গাব্দে বর্তমান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব অংশে সু-সঙ্গ নামে এই পরগনার পত্তন হয়। সেই সময় অভিযাত্রী মার্কোপোলো পৌছেছেন তাঁতার সম্রাট কুবলাই খাঁর দরবারে। মার্কো পোলোর কাছে কুবলাই খান যখন জেনে নিচ্ছেন তাঁর না জানা জগতের নানা শহরের মানুষ আর বৈভবের কথা, সেই ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে আর এক অভিযাত্রী, কিংবা ভাগ্যান্বেষী সোমেশ্বর পাঠক কান্যকুব্জ থেকে মৈমনসিংহ জিলার উত্তর পূর্ব দিকে পাহাড়িয়া অঞ্চলে এসে পৌঁছন লোক-লস্কর সমেত। আসলে কামরূপ দেশ, লৌহিত্য নগরেই ছিল তাঁর আসা, তারপর কৌতুহলে এই কুমারী মৃত্তিকা অভিযান। সিমসাং নদীর তীরে দুর্গাপুর তাঁর পছন্দ হয়। এখানেই হয় তাঁর যাত্রাবিরতি। তখন এই দেশ ছিল ‘বৈশ্য গারো’ নামের এক মহাশক্তিধর এক গারো রাজার অধীন। লোকে বলে, গারো রাজা ছিল অত্যাচারী। সত্য মিথ্যা কে জানে ? গারো রাজা নিষ্টুর আর অত্যাচারী হলে সোমেশ্বর পাঠক হৃদয়বান এবং প্রজা বৎসল হন, তাইই হয়েছেন। গারো রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে সুসঙ্গ দেশের প্রতিষ্ঠা। সোমেশ্বর পাঠকই প্রথম সুসঙ্গ রাজা। রাজা হয়ে তিনি সিংহ হলেন। গারো রাজাকে যেমন শেষ করলেন, তাদের নদীর নাম নিজের নামে করলেন। সিমসাং হলো সোমেশ্বরী।
শুনতে শুনতে বিস্মিত বিপুল বলল, গারোদের নিঃস্ব করে সুসঙ্গ ?
হ্যাঁ, নদীর নামটি বদল করে দিয়েছিলেন ঐ রাজারা, গারোদের চিহ্ন বিলুপ্ত হলো, পরাজিতের কিছুই রাখতে চায় না শাসক, বললেন অতীন সরকার, পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পুবে একই কথা।
বিপুল বলল, ইউ,এস,এ-তে এমন হয়েছে শুনেছি, আপনি জানেন ?
অতীন বললেন, সব বদল হয়ে গেছে, নেটিভ আমেরিকান, নানা উপজাতিদের কিছুই নেই আর।
বিপুল বলল, আমিও তাই শুনেছি, খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারকদের নামে নগর, ্পাহাড় নদী্র নাম হয়ে গেছে অনেক, কিন্তু সবটা নয় ।
চন্দ্রকুমার বলল, এখন আবার সিমসাং নামে ডাকা শুরু হইসে, ফিরে আসসে সিমসাং।
অতীন বললেন, হবে তা, তারা তাদের নিজের নদী ছাড়বে কেন ?
কিন্তু আমরা তো জানি সোমেশ্বরী। চন্দ্রকুমার বলল।
বিপুল বলল, আপনি বলুন হাতি খেদার কথা।
অতীন নন, জোয়ান অথৈচন্দ্র গর্জন করে ওঠে, হাতি খেদানর কাজ আর করবনি, আর উ গাঙের নাম সিমসাং করৎ থামব।
হাঁ হাঁ, গাঙের নাম সিমসাং হবে, হাতি খেদা হবেনি, পাঞ্জালী আর ঘেরাউয়ের কাজ করবনি।
পাঞ্জালী হলো দুর্গের ভিতর আটকে ফেলে যে অসম সাহসী জোয়ানরা বর্শা দিয়ে খুচিয়ে ক্রুদ্ধ হাতিকে থামাতো। হাতি ধরতে অনেক লোক দরকার হয়। তিন-চারশো। তাদের বেশিরভাগ হয় আগুন জ্বালিয়ে টিন পিটিয়ে হাতিকে শালবল্লী আর শক্ত কাঠে নির্মিত দুর্গের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করে। দুর্গের দিকেই হাতিকে খেদিয়ে আনা হয়। দুর্গের মুখ গাছপালা দিয়ে এমন করে রাখা হয়, যাতে হাতি না বুঝতে পারে তারা বনের বাইরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। হাতি ধরা করতে গিয়ে হাজংরা কম মরেনি। বনের হাতির দলকে ভয় দেখাতে গিয়েই হাতির পায়ের নিচে পড়ে মরেছে। হাতি খুব বুদ্ধি ধরে। তবে মানুষের কূট বুদ্ধি অনেক বেশি। কূট কৌশলের বুদ্ধিই তো শাসকের প্রধান গুণ। যে যতো কৌশলী হবে সে শাসন করতে পারবে ততো বেশি। তো অথৈ যখন বলল , হাতি খেদার কাজ করবনি, সেই কংস নদীর ধারের গাঁ চম্পানগর গাঁয়ের মেয়ে ঘরবন্দী। তার বাপ শীতলচন্দ্রকে খুব তিরস্কার করেছে ব্রাহ্মণ ত্রিলোচন চক্রবর্তী। শীতল নিজেও ব্রাহ্মণ, কিন্তু পতিত, কেন পতিত না সে গারো পাহাড়ের মেয়েকে বিয়ে করেছিল। গুরু ত্রিলোচন তাকে পরিত্যাগ করেছিল। গাঁ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। চম্পা নগর কৈবর্তদের গ্রাম। বামুন সে কিসে তা জানে না। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানে না। জানত সব, গারো মেয়েকে বিয়ের পর ভুলেছে সব। যজমানি তার নেই। আগেও ছিল না। সব বামুন সমান হয় না, যেমন সব মানুষ ধলা হয় না, সব নারী সুন্দর হয় না, রাজা প্রজা এক হয় না। বামুন হয়ে সে অব্রাহ্মণের কাজ করত। তখন দেহে খুব তেজ ছিল। এখন তেজ কমেছে, শীতল হয়েছে শীতল। তার তেজ পেয়েছে লীলাবতী। গারো মেয়ের মতো তেজ। শঙ্খিনীর মতো ফুঁসছে সে ঘরে বসে। বামুন আসছিল দূর গাঁয়ের শিষ্যঘর থেকে। পূর্ব ধলায় বামুনের ঘর, কংস নদীর ওপারে। সাঁঝের আগে গাঙ পেরুতেই বামুন বনপথ ধরেছিল। তখনই দেখেছে নর নারীর কুক্কুরী মিলন। হ্যাঁ, সে বলল তাই। অমন সুন্দর সেই কন্যা, সে কি না বনের ভিতর কুক্কুরী মিলনে মত্ত। কিন্তু পারেনি। মেয়েটাকে ধর্ষণ করতে গিয়েছিল পাহাড়ি হাজং এক। কী কান্ড, বামুনের মেয়েকে বনের ভিতরে নিয়ে এই কান্ড ! বামুন হাঁক মারতে জোয়ান মদ্দ পালিয়েছিল, আর মেয়েটা ধরা পড়ে নিজেকে সামলে কাঁপছিল। কোন ঘরের কনিয়া তুই ?
জেনে কী হবে বামুন ঠাকুর ?
আমি যদি হাঁক দেই সব ছুটে আসবে, আমি যদি শাপ দেই, ভস্ম হয়ে যাবে সে গুয়োরবেটা, তার ছায়া মাড়ানো পাপ, সাতবার গাঙে ডুব দিতে হয়।
আ্মুও বামুন ঘরের, বাপের নাম শেতল, আমুও জানি ভস্ম করতে। লীলাবতী গর্জে উঠেছিল তেজে, কত বড় বামুন তুমি গো, তুমি কেনে দেখস, তুমি পাপ করস, গাঙে ডুব দিয়া ঘর যাও।
বামুন বলল, দেখি কী করা যায়, তোরে আমি দেখে নেব।
কী দেখবা, আমু পীরিত করসিলাম, বুড়া তুমার কি পীরিতের ক্ষ্যামতা আসে ?
মেয়ে নয় তো বাঘিনী। মেয়ের রূপে আগুন জ্বলছে। বামুন তার রূপ দেখে পাগল। কী যৈবন তার ! সে ত্রিলোচন বামুন।বুদ্ধি ধরে খুব। নরম গলায় বলল, ঘরে যা কনিয়া, অমন কথা বলসিস কেনে, বামুন ঘরে জম্মো, বাপ বামুন, মা পাহাড়িয়া, আমি জানি, যা তুই ঘরে যা।
মেয়ের হাতের পাতায় তখনো যেন স্পর্শ রয়েছে অথৈচন্দ্রের অবরুদ্ধ পৌরুষের। পৌরুষে প্রায় সিক্ত হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু তার অনেক ক্ষমতা সংবরণের। তারা যখন ভূমিতে লগ্ন হবে, তখনই ত্রিলোচনের আবির্ভাব। কন্যা ফুঁসছিল তার বাসনা অচরিতার্থ থাকায়। হেঁটেছিল বাড়ির দিকে। তখন বামুন ঘাটে এসে মাঝিকে বলেছিল, যা দেখি, ডেকে নিয়ে আয় শেতল বামুনকে।
সে তো আর বামুন নাই ঠাকুর। মাঝি গড় হয়ে বলেছিল।
নাই কি আসে, সে আম্মু কইব, তুই প্যাঁচাল পাড়িস কেনে ?
মাঝির চলতি নাম ঢেউ। তরঙ্গচন্দ্র। মাঝির বয়স বছর পঁচিশ। মাঝি কৈবর্ত। মাঝির খুব ইচ্ছে শেতলচন্দ্রের ঐ কন্যাকে বিবাহ করে। প্রস্তাব দিয়েছিল লীলাবতীকে। লীলাবতী হেসে বলেছিল, তুই গাঙের মানুষ, গাঙেই থাকিস, গাঙের ভিতর থেকে উঠি আসি মৎস্যকইন্যা তুরে বিবাহ করৎ পারি, আমি কেডা, মতস্যকইন্যা বিবাহ কর।
হতাশ এবং ক্রুদ্ধ তরঙ্গচন্দ্র তখন লীলাবতীর বাবা শীতলচন্দ্রকে প্রস্তাব দেয় একদিন গাঙের ভিতর নিয়ে গিয়ে। তার মনে হয়েছিল যদি তার প্রস্তাবে ‘না’ বলে, মাঝ গাঙে ফেলে দেবে। হয় হ্যাঁ বলো, না হয়, না। কিন্তু শীতলচন্দ্র বলেছিল, হবে না, সে আসলে বামুন, কপাল দোষে পতিত হইসে, তার সেই বউ বাঁচল না। সে কৈবর্তের ঘরে মেয়ে দেবে না। তার জন্য যদি মরতে হয় মরবে, কিন্তু মরার আগে ব্রহ্মশাপ দিয়ে যাবে। তাতে বজ্রপাতে মরণ হবে তরঙ্গচন্দ্রর। তরঙ্গর মনে হয়েছিল শীতলচন্দ্র বামুনকে মেরে লাভ নেই। তার আশা পূরণ হবে না। শীতলকে মারলে, মেয়েটা গারো পাহাড়ে চলে যাবে ঠিক। তার চেয়ে অপেক্ষা করা ভালো। দেখা যাক, যদি সুযোগ আসে। সুযোগ এসেছে। হাজং পাহাড়িয়া এসে কংস নদীর ধারের মেয়ে নিয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। সে হাঁটল শীতল বামুনের বাড়ি, আছ নাকি ?
মেয়ে তখন ভিটের পিছনের পুকুরে ডুব দিচ্ছিল, বাগানের পাখিকে ভেংচি দিচ্ছিল অবিকল তার মতো করে শিস দিয়ে ডেকে ডেকে, চখ গেল……। তরঙ্গ ্মাঝি গুটিগুটি ভিটের পিছনে গিয়ে আবার হাঁক দিয়েছিল, আছ নাকি বামুন মশায় ?
এই ভাগ, সমুখ থেকে যা। মেয়ে হেঁকে উঠেছিল, কেডা এইসে দ্যাখো বাবা, সেই মৎস্যকইন্যার বর।
শীতলচন্দ্র বেরিয়ে এসে হাঁক-ডাক শুরু করেছিল, আবার কেনে, না করিসি আমি, ডেউ তুই যা।
মাঝি বলল, পূর্ব ধলার তিলোচন ঠাকুর তুমারে ডাকে মশায়।
ঠাকুরমশায় এইসে ?
ঘাটে বসে রইসে, আসো তুমি মশায়।
শীতল তড়িঘড়ি ছুটেছিল ঘাটের দিকে। মেয়ে স্নান করে ঘরে এসে দ্যাখে তার বাবা নেই। মন কু ডাক দিয়েছিল। কিন্তু তার মনে তখন টলমল করছিল অথৈচন্দ্র। গা ধুয়ে এসেও তার ছোঁয়া যাচ্ছে না। দাঁতের দাগ দিয়ে গেছে সে দুই বুকেই। আঁচল নামিয়ে দেখতে দেখতে তার শরীর যাঞা করে অথৈচন্দ্রকে। মন গুণগুণ করছে। সে চুলো জ্বালিয়ে ভাত চাপিয়েছিল। চুলোর সামনে বসে ভাবছিল অথৈচন্দ্রের কথা। তখন সেই নদী ঘাটে ত্রিলোচন ঠাকুর বলছিল সব। মেয়েটা ভেসে যাবে যে। কোন শূদ্দুর না চাঁড়ালের অধম হাজং বেটা কিংবা গারো বেটা কিনা তার মেয়েটাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছিল। বেটি বাঁচাও শেতল।
কী করে বাঁচাই ঠাকুর মশায়, বিবাহ দেব কোথায়, পতিত হইসি, এখন কি আর হাজং পাহাড়িয়া ছাড়া ওর বর জুটবে ?
ত্রিলোচনের সামনে ভেসে উঠল লীলাবতী। লীলাবতী বড় সুন্দর! তার বয়স হয়েছে। শরীর তেমন পোক্ত নয়। কিন্তু মনের বাসনা এখনো প্রজ্জ্বলিত। আর লীলাবতীকে দেখে সেই আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত পুরুষের বাসনা মেটে না। ত্রিলোচন বলল, পুরুষ মানুষের বয়স বিচার করৎ কেডা, দরকার নাই, ভাত জুটলেই হবে।
হাঁ ঠাকুর। যুক্ত করে ত্রিলোচনের কথায় সমর্থন জানায় শীতল।
তুই বামুন খুঁজ, কইন্যার যৈবনকাল যাচ্ছে, কত ভোমর মুখ দিবে, বিবাহ দিয়া দে, এই সময় মন আর দেহ আগুনে চঞ্চল হয়, উয়ারে শেতল করা দরকার, আর বামুন ঘরে বিবাহ দিলে তুর পতিত দশা ঘুঁচবে।
বামুন ঘরে বিবাহ দিব, পতিত বামুনের কইন্যাকে কে বিবাহ করৎ কেডা পতিত হবার চায়।
বিধান দিবে তিলোচন ঠাকুর, বামুন যেমন পতিত হয়, উত্থিত হয় তেমন, উত্থানের জন্য মেয়েমানুষ দান করা আবশ্যিক। বলে ত্রিলোচন নাওয়ের দিকে এগোয়। কিন্তু তাকে আটকায় শীতল। দেহ ক্রমশ অশক্ত হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে যদি তার পতিত দশা কাটে, তবে সে আবার একজনকে ঘরে আনবে। অবশ্যই বামুন ঘর থেকে আনবে। বামুনের যেমন ক্ষমতা আছে সমাজে, বামুনের বিধানে সমাজ নড়ে চড়ে, বিবাহ করে সে আবার সেই বামুন হবে। কায়িক শ্রমের ক্ষমতা গেছে, সে এখন পুজো-আচ্চা, যজমানি করে বেড়াবে। সে ত্রিলোচন ঠাকুরকে ডাকে তার ঘরে, ঠাকুর আসেন আপনি মুর ভিটায়, শাস্তর শিক্ষা দেন।
শীতল খুব বুদ্ধিমান। সে ভাবছিল কোনোক্রমে যদি ত্রিলোচন ঠাকুরকে তার ভিটেয় নিয়ে তুলতে পারে, তাতেই তার পতিত দশা যাবে অনেকটা। প্রমাণ হবে তার ভিটে তাহলে ব্রাহ্মণের নিকট নিষিদ্ধ নয়। তাতে তার মেয়ের বিয়ে দেওয়া সুবিধে হবে। কিন্তু শীতলের কথায় মাথা নেড়েছে ঠাকুর, তাই কি হয়, আগে তোর উত্থান হোক, তবে আমি তোর গিহে যাব।
ঠাকুর আপনি একটা বামুনের বেটা জুগাড় করে দেন। শীতল হাত কচলে বলে।
মু কুথায় পাবো, কইন্যার কি অভাব যে পতিতের কইন্যাকে বিবাহ করৎ সদ ব্রাহ্মণ পতিত হবার ঝুঁকি নিবে। ত্রিলোচনের কন্ঠ কর্কশ হয়ে যায় আচমকা।
শীতল কালো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে খুব প্যাঁচে পড়ে গেছে। ত্রিলোচন তখন নরম হয়ে বলে পরেরদিন তার বাড়ি যেতে। তখন যদি কোনো উপায় বাতলাতে পারে সে। তাই হবে। যাবে শীতল। ত্রিলোচন ঠাকুর পার হয়ে যায় কংস নদী। বেলা পড়ে যায়। ঘরে ফিরে শীতল মেয়েকে খুব তিরস্কার করে, ছি ছি ছি, হাজঙের বেটার সঙ্গে বনে গিসিলি, বামুন ঠাকুর তিলোচন দেখে ফেলিসে।
লীলাবতীর বাসনা মেটেনি। এখন তার কামনা বাসনা অথৈ। বামুন ঠাকুর তাদের ছিন্ন করেছে পরস্পর থেকে। কুক্কুরী কুক্কুরীর মিলন বলে বামুন কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠেছিল। লীলাবতী অগ্রহায়ণ মাসে স্ত্রী পুরুষ সারমেয়র মিলন দেখেছে। দুষ্ট ছাওয়ালরা লাঠি দিয়ে আঘাত করে তাদের ছিন্ন করে। লীলাবতী আজ বুঝেছে কামনা কী। মিলন কী। আর মিলনের সময় নারী পুরুষের ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্ট কী ? শয়তান বামুন ! লীলাবতী শঙ্খিনীর মতো ফুঁসে উঠল, বলল, বেশ করিসি।
বেশ করিসি মানে ?
আমি তারে বিবাহ করব।
শীতল বলল, না, আমি যে ভুল করিসি, তা করতি দিব না।
তুমু মারে শেষ করিসিলে। বলে উঠেছিল লীলাবতী, মারে মেরিস তুমি।
শীতল বলেছিল, তুই শয়তানের হাতে পড়িসিস, সাবধানে কথা বল।
আমি অথৈচন্দররে বিবাহ করব।
তার আগে তোরে মেরে কংস নদীর জলে ভাসায়ে দেব।
লীলাবতী বলেছিল, আমার মারে তুমু চিকিচ্ছে করোনি, কবরেজ ডাকোনি, তাই মরে গেল, মু জানি।
সাবধান লীলা, তোর ব্যবস্থা আমি করতিসি।
লীলাবতী বলেছিল, বাপ মু অথৈচন্দরের বউ হবো।
না হবেনি, হাজঙ, হাতিখেদার সঙ্গে মু বিবাহ দিবনি। শীতল বলে উঠেছিল।
(চলবে)